Tuesday, July 31, 2018

এনআরসি সম্পর্কিত (লিখেছেন শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্য)

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্য ফেসবুকে লিখেছেন  (আমি নিজের খাতায় টুকে রাখলাম)
" এনআরসি-সম্পর্কিত সমস্যা শুরু হয়েছিল দেশভাগের পরপরেই, যখন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের থেকে ভারতের নাগরিকদের আলাদা করে চিহ্নিত করবার প্রয়োজনীয়তা থেকে ১৯৫১ সালে প্রথম এনআরসি তালিকাটি আসে। আসামে তিরিশের দশক থেকেই তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, মূলত ময়মনসিংহ থেকে কৃষিজীবীদের যাতায়াত ছিল। সেই সূত্রে, তারপর ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে প্রচুর মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে আসামে চলে এসেছিলেন। সেইজন্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বারে বারে দাবী উঠেছিল ১৯৫১ সালের এনআরসি তালিকাটি আপডেট করবার। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আসামের ভূমিপুত্রদের বহিরাগত বিদ্বেষের বিষয়টিও। কমিউনিস্টদের বিশাল প্রভাব ছিল সত্তরের দশকে। সিপিআই(এম) বৃহত্তম পার্টি ছিল আসামে। সেটাকে কাটবার জন্য এবার আসরে নামে আসু। বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ১৯৭৯ সালে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা সংক্ষেপে আসু-র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই বিদ্বেষ ভরবেগ লাভ করে, এবং ১৯৮৩ সালে নেলী-র গণহত্যা সমস্যাটিকে তার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দেয়। ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধী সরকার এবং আসু-অগপ জোটের মধ্যে আসাম শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হবার পর কিছুকাল পরিস্থিতি শান্ত হয়েছিল। ২০০৫ সালে তৎকালীন তরুণ গগৈ সরকার এবং আসু-র মধ্যে আবার চুক্তি হয়, যা অনুযায়ী এনআরসি তালিকাকে নবীকরণ করবার বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছিল। এবার এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনেওয়াল ঘোষণা করে দিয়েছেন যে এনআরসি তে নাম না ওঠা মানুষজনের কোনো নাগরিক, সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার থাকবে না। বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের হুমকি দিয়েছেন তিনি, তাদের চিহ্নিত করে সমস্ত সুযোগ সুবিধা এবং অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। একধাপ এগিয়ে কাছাড়ের ডিসি এস লক্ষ্মনণ জানিয়েছেন, এন আর সি তে নাম উঠলেও নিশ্চিন্তির অবকাশ নেই। নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে কারও অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষে খসড়া এনআরসি থেকে কারও নাম বাদও যাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, আসাম ধীরে ধীরে একটি পুলিশ রাষ্ট্র হয়ে ওঠবার মুখে, যেখানে দেশের মধ্যে থেকেও নাগরিকদের বসবাস করতে হবে নিয়মিত রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুর তলায়।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণের ন্যায়সঙ্গত কর্মসূচিটিকে কেন ধিক্কার জানানো হচ্ছে। একথা ঠিকই যে এনআরসি-র দাবী বহুদিনের এবং আসামের জনজাতির এই বিষয়ে কিছু বাস্তবসম্মত ক্ষোভও রয়েছে। বাস্তবে, বিজেপি-আরএসএস এতদিন এনআরসির বিরোধী ছিল কারণ নিখুঁত এনআরসি প্রকাশিত হলে দেখা যেত যে বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা মুসলিমদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। এখন ক্ষমতায় এসে তারা যখন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে, তখন যুক্তিসঙ্গত অভিযোগগুলির জায়গাতে তারা নিজস্ব দক্ষিণপন্থী রাজনীতির রূপায়ণ ঘটাচ্ছে। সমস্যাটা সেখানেই । আসামের ঘনঘন প্রলয়ঙ্কারী বন্যা এবং ভয়ঙ্কর ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষের বলি হয়ে বহুবার জনগণকে সর্বস্ব হারিয়ে ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এসব প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট ঘটনায় জনগণ একদিকে যেমন তাদের জীবন, সম্পত্তি এবং বহু মুল্যবান নথিপত্র হারিয়েছেন, অন্যদিকে দেশ বিভাগের বলি হাজার হাজার অসহায় মানুষ গত পঞ্চাশ-ষাট বছর যাবত আসাম সহ ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে খাস জমি, বনাঞ্চল, বস্তি এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করে আসলেও তাঁদের হাতে কোনও ধরণের সরকারী নথি প্রদান করা হয়নি ৷ আজ এত বছর পর জনগণের পক্ষে এসব নথি সংগ্রহ করা যে অসম্ভব তা জানা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে শুধু দলিলের ওপর ভিত্তি করে নাগরিকপঞ্জী তৈরী করার আসল উদ্দেশ্য নাগরিকত্ব প্রদান নয়, নাগরিকত্ব হরণের অপচেষ্টা মাত্র।
এনআরসির বর্তমান প্রণয়নটি যে আসলে বিজেপি-র মুসলিম-বিস্বেষী কর্মসূচিকেই রুপায়ণ করছে সেটা বোঝবার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট। এনআরসি ভিত্তিবর্ষ অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত প্রমাণপত্র থাকলেই সবধর্মের মানুষের নামই পঞ্জীভুক্ত হবে। কিন্তু নাগরিকত্ব বিল অনুযায়ী ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুসলমান বাদ দিয়ে অন্য সব ধর্মের মানুষই নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন, অতএব নাগরিকত্ব পাবার অধিকারী। ফলে যা দাঁড়ালো ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিম ব্যতিরেকে অন্যসব ধর্মের মানুষই নাগরিক হবেন, এটা ধরেই নেওয়া হচ্ছে। ফলে এনআরসি শুধুমাত্র মুসলিমদের মধ্যে কারা সঠিক ভারতীয় আর কারা অনুপ্রবেশকারী এটুকু ঠিক করবার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং পর্যবসিত হচ্ছে মুসলিম নাগরিকপঞ্জিতে। এছাড়াও আরেকটি যে গুরূত্বপূর্ণ প্রশ্ন, নাগরিকত্ব সংশোধন বিলে ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর অবধি বাংলাদেশ, আফগানিস্তানে এবং পাকিস্তানে নির্যাতনের শিকার হিন্দু বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক, খ্রীস্টানদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে মুসলিম ধর্মান্ধদের বলি মুসলমান, (যেমন ব্লগার বা জামাত বিরোধী বা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি, জিহাদিদের টার্গেট, রাজাকার-বিরোধী গ্রুপের সদস্য) তাঁদের আশ্রয়, এবং চাইলে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না কোন যুক্তিতে? তাঁদের কেন অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হব্যে?
যেখানে বিজেপির উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম খেদানো, সেখানে অগপ আশুর উদ্দেশ্য হলো হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালী, সাঁওতাল, নেপালী, আদিবাসী চা-শ্রমিক, এবং উত্তরভারতীয় দিনমজুর খেদানো। হিংস্র অসমীয়া উগ্র জাতীয়তাবাদের পিঠে চড়ে অগপ আসামের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছিল। বিজেপি সেই জাতীয়তাবাদের উপর একটি উগ্র-মুসলিম বিদ্বেষের চাদর চড়িয়ে তাকে আরো জমকালো করে তুলেছে। এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টিকে বাঙালী সেন্টিমেন্টের রঙ দিয়ে যেভাবে সস্তা রাজনৈতিক ফায়দা লোটবার খেলায় নেমেছেন, তাতে সমস্যা আরো জটিল হবে। কারণ নেপালী অথবা উত্তরভারতের যে গরীব দিনমজুর অগপ-বিজেপি-র উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরা কেউ বাঙালী নন। প্রশ্নটি আসলে শ্রেণির, যেহেতু অন্য দেশ বা অন্য রাজ্য থেকে কাজের সন্ধানে আগত তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীরা সিংহভাগই গরীব মানুষ। অনুপ্রবেশকারী হিসেবে একবার চিহ্নিত হয়ে গেলে তাঁরা যখন কর্মহীন হয়ে পড়বেন রাতারাতি, তাঁদের অর্থনৈতিক অথবা রাজনৈতিক জোর থাকবে না যার সাহায্যে তাঁরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়তে পারবেন। "